Header Ads

মাদকাসক্ত: একটি জীবনের মৃত্যুদণ্ড


সাহাদাত সাঈদ

দেশের সবচেয় বড় আলোচিত ঘটনা ঐশী হত্যা মামলা। এ মামলার তদেন্ত বেরিয়ে এসেছে ঐশীর বেপরোয়া জীরন যাপন। ইয়াবা, মাদকাশক্তের মত নানা ধরনের নেশা ও অসৎ সঙ্গ। আর শেষ পরিণতির বলি হতে হলো ঐশীর বাবা-মা এবং শেষ পর্যন্ত ঐশী নিজে। এখন প্রশ্ন হলো এই পরিণতির জন্য কে দায়ী। সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ ধরনের অবস্থার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে পারিবারিক বন্ধন না থাকা, সমাজের অবক্ষয় ও মাদকাসক্তই প্রধানত দায়ী।

আজকাল পারিবারিক বন্ধন নেই বললেই চলে। পরিবারতন্ত্র ভেঙ্গে গেছে, একক পরিবার এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। এখনকার পিতা-মাতারা বেশির ভাগই একক পরিবার হিসেবে থাকে। সকাল হলেই তারা ছুটে যায় অফিস আদালতে আর ফিরছে রাতে। মাঝখানে ছেলে-মেয়ে কোথায় যাচ্ছে কি করছে তার কোন খোঁজ-খবর অনেক পিতা-মাতার কাছে নেই।

এই সুযোগে ছেলে-মেয়েরা জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অনৈতিক কাজে। বন্ধু-বান্ধবীদের চক্করে পড়ে নেশার সাথে জড়িয়ে পড়ছে। আস্তে আস্তে করে তারা হারিয়ে যাচ্ছে নেশার অজানা রাজ্যে। আর নেশার টাকা যোগার করতে প্রথম মা-বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি শুরু হয়। এর পর নানা অপকর্ম করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না। ঐশী তার বাস্তব প্রমাণ।

নেশার ঘোরে ঐশী কি করছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছিলো না হয়তো। এখন হয়তো সে অনুধাবন করছে সে যা করছে তা মোটেই ঠিক ছিল না, যখন সে এটা বুঝতে পারলো তখন সব শেষ।

মাদকাসক্তির কথা এক সময় ঐশীর বাবা-মা জানতে পারেন। মেয়ের মাদকাসক্তির কথা যখন জানলেন তখন ঐশী নিয়মিত ইয়াবা সেবন শুরু করেছে। আর ইয়াবার যোগান দিত বন্ধুরা ও পরিবার থেকে লুকিয়ে অর্থ নেয়ার মাধ্যমে। আর সেই বন্ধু-বান্ধব ছিল তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। মাদকাসক্ত হয়ে প্রায়ই ঐশী তার বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন। কোন রকম নিয়ম কানুনের মধ্যে থাকতেন না। বাসায় তো রাত করে ফিরতেনই, সঙ্গে থাকতো ছেলে বন্ধু।

উচ্ছশৃঙ্খলতা যখন চরম পর্যায়ে তখন বাবা-মা বোঝাতে চেষ্টা করেন মেয়েকে। কিন্তু ইয়াবার নিকষ কালো অন্ধকারে ততদিনে ডুবে গেছেন ঐশী। বাবা-মা যত বাধা দেন, ইয়াবার ঝাপসা ধোয়ায় ঐশীর কাছে তারা তখন চরম শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকে।

ধীরে ধীরে এই শত্রুতা আরো বাড়ে। ঐশী কোনোভাবেই বাবা-মায়ের শাসন মেনে নিতে পারছিলো না। কিভাবে তাদের শায়েস্তাা করা যায় ভাবতে থাকে। একপর্যায়ে ঠান্ডা মাথায় খুন করে বাবা-মাকে।

২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট, রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগে নিজেদের বাসায় হত্যা করে নিজের বাবা-মা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানক। মা-বাবাকে খুন করার পর পালিয়ে যায় ঐশী।

এ ঘটনায় ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান রুবেল পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। একই বছরের ১৭ আগস্ট ঐশী রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন। এর পর ২৪ আগস্ট আদালতে খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন ঐশী।

আদালতের জবানবন্দিতে ঐশী জানায় , ঘটনার আগের দিন জনি নামের এক বন্ধুর কাছে সে বাবা-মাকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানায়। হত্যার পর তাকে আশ্রয় দেওয়ার আশ্বাস দেয় জনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐশী ছয় পাতার ৬০টি ঘুমের ট্যাবলেট কেনে। ৩০টি করে ট্যাবলেট মা-বাবার কফিতে মেশায়। মা-বাবা কফি খাওয়ার পর অচেতন হয়ে পড়ে।

এরপর প্রথমে বাবাকে ছুরিকাঘাত করে ঐশী। বাবা গোঙাতে থাকলে ওড়না দিয়ে বাবার রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। বাবার গোঙানির শব্দে মা জেগে ওঠেন। মা পানি চায়। পানি খাওয়া শেষ হলে ঐশী মায়ের শরীরে বেশ কয়েকবার ছুরিকাঘাত করে। শেষমেশ মায়ের শ্বাসনালীতে ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর ঐশী ও গৃহকর্মী মিলে দুজনের লাশ বাথরুমে নিয়ে লুকিয়ে রাখে। রক্ত পরিষ্কার করে সকালে জনিসহ তিনি বেরিয়ে যায়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মেয়েদের মাদক গ্রহণের পরিমাণ এখন উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। দেশে ৮০ লাখ মাদকাসক্তের ৩০ ভাগই এখন মেয়ে! তাদের বয়স ১৪ থেকে ২১ বছরের মধ্যে।

এ প্রতিবেদেন আরো বলা হয়, কেউ মাদকাসক্ত হলে তার চিকিৎসা না করিয়ে আটকে রাখা বা তার মতের বিরুদ্ধে কথা বলে তাহলে তার মধ্যে প্রতিহিংসার জন্ম নেয় এবং এই নির্মম ও করুণ হত্যাকান্ডের মত ঘটনা ঘটে। তাই মাদকাসক্ত সন্তানদের চিকিৎসার উপর জোর দেয়া হয় এ প্রতিবেদনে।

মাদকদ্রব্য নিযন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেয়া এক তথ্যে জানা যায়, ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৬৬টি মামলা দায়ের করা হয় এবং এ সময়ে আসামীর সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৭ লাখ ১ হাজার ৭৯৮ জন। অপরদিকে সকল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মামলা অনুসারে, শুধু ২০০৯ মাদকদ্রব্য সেবন ও বহন করার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয় ২৭ হাজার ৪৪১টি এর মধ্যে আসামী ছিল ৩৪ হাজার ৩১৫ জন, ২০১০ সালে মামলা দায়ের করা হয় ২৯ হাজার ৬৬২ আসামী ৩৭ হাজার ৫০৮ জন, ২০১১ সালে মামলা হয় ৩৭ হাজার ৩৯৫টি, আসামী ৪৭ হাজার ৪০৩ জন এবং ২০১২ সালে মামলা হয় ৪৩ হাজার ৭১৭টি আসামী করা হয় ৫৪ হাজার ১০০ জনকে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা ১৯৯০ এর ধারা ১৯ এ মাদক আইনে গ্রেফতারকৃতদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এতে কারাভোগের ক্ষেত্রে অন্তত ২ বছর থেকে ১৫ বছর কারাভোগের কথা বলা হয়েছে। আসামীদের মামলা পরিচালনা ও কারাগারে রেখে তাদের খাওয়া, পোশাক-আশাক, চিকিৎসা ইত্যাদি বাবদ প্রতি বছর সরকারের ব্যয় দাঁড়ায় ন্যূনতম ৫০ কোটি টাকা। এছাড়া এদের দমন ও নিয়ন্ত্রণে সরকারকে পোহাতে হয় বাড়তি টেনশন।

অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধান তিনটি আফিম ও আফিমজাত পণ্য উৎপাদনকারী অঞ্চলের কাছাকাছি একটি দেশ। ১৯১৭ সালে সমবায় ভিত্তিতে নওগাঁ জেলায় সর্বপ্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয়। স্বাধীনতাপূর্ব কাল হতে বাংলাদেশে ছিল সীমিত সংখ্যক লাইসেন্সধারী আফিমসেবী।

কিন্তু স্বাধীনতার পর গাঁজা ও মদের প্রচলন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৩-৮৪ সালের আগে আমাদের দেশের কেউ হেরোইন চিনত না। অথচ ব্যাপকভাবে হেরোইন চোরাচালান বৃদ্ধি ও বাংলাদেশে তার বাজারজাত করণের ফলে ৮৫-৮৬ সাল থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত হেরোইনসেবীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ১৯৮৭-৯১ সাল পর্যন্ত বিশেষত তরুণ ছাত্র সমাজের মধ্যে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়।

নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও ধরা হয়, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব ঘটে। তবে ২০০৫ সাল থেকে জেলা ও থানা পর্যায়ের তরুণ-তরুণীর হাতে ইয়াবা ট্যাবলেট চলে যায়। এর আগে ২০০০ সাল থেকে সীমান্তপথে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হয়ে তা দেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে।

মাদক বিস্তারের প্রধান কারণ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য অনুসারে, অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশকে পঞ্চাশের দশক থেকে অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র বাংলাদেশকে মাদকাসক্তি চোরাচালানের করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

প্রধানত মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী অঞ্চল থাইল্যান্ড, লাওস, বার্মা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, ভারত ও নেপাল সীমান্তের বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশী। এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য উৎপাদনে ও ব্যাপক ব্যবহারে দীর্ঘদিন ধরে মুক্ত ছিল। ফলে আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ সংস্থার কার্যাবলী ও তাদের সন্দেহের বাইরে রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীরা সুযোগকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ হেরোইনের ব্যাপক চালান আসত বার্মা ও থাইল্যান্ড থেকে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৯০ লাখ লোক মাদকাসক্ত। সরকারি হিসাব মতে এ সংখ্যা ৫০ লাখ। এদের মধ্যে ৭০ ভাগ হেরোইন বা এডিন সুগারে আসক্ত। আর ৩০ ভাগ ফেন্সিডিলে আসক্ত। আর বর্তমানে বহুল প্রচারিত যৌন উত্তেজক মাদক ইয়াবা আসক্তের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে দিন দিন এর চাহিদা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শুধু ঢাকাতেই ইয়াবার দৈনিক চাহিদা ১৪ লাখ। চট্টগ্রামে ১০ লাখের মতো আর কক্সবাজারে এর সংখ্যা ৫ লাখ।

বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কত সে নিয়ে তেমন কোনো জরিপ হয়নি। তবে বিভিন্ন পরিংখ্যানের তথ্য অনুসারে বর্তমানে ৯০ লাখের অধিক মানুষ মাদকাসক্ত যার মধ্যে ৮০ ভাগই যুবসমাজ। মাদকের অর্থ যোগানে যুবকেরা বিভিন্ন অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পরছে। দেশে বর্তমানে ৩০ ভাগ মাদকাসক্ত ব্যক্তি খুন-জখম, অপহরণ, ছিনতাই, চুরি, ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িত রয়েছে।

এ ধরনের অপরাধ থেকে ছেলে-মেয়েকে বাঁচাতে না পারলে এধরনে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না তা কে বলতে পারে। তাই সময় থাকতে ছেলে-মেয়ের নৈতিক শিক্ষা, আচার-আচরণ, চলা-ফেরা, বন্ধু বান্ধবদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে অবিভাবকদের।

সাংবাদিক ও লেখক 

No comments

Powered by Blogger.